নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে বাংলাদেশের দারুণ জয়
ভূমিকম্পের দেশ থেকে এত দূর এসেও নিউজিল্যান্ডের রেহাই নেই। আজ সকাল সকাল সিলেটের মাঠে দাঁড়িয়েই তাঁরা হয়তো টের পেলেন পায়ের নিচে মাটি মৃদু কেঁপে উঠছে। ‘মৃদু’ বলার কারণ, সকাল ৯টা ৩৫ মিনিটে রিখটার স্কেলে ৫.৬ মাত্রার ভূমিকম্পটি রাজধানী ঢাকাসহ চট্টগ্রাম, নোয়াখালী ও কুমিল্লার দিকে যে রকম প্রবল দুলুনি দিয়ে গেছে, সিলেটে সে তুলনায় এর ধাক্কা ছিল না বললেই চলে।
তবে সিলেট টেস্ট নিউজিল্যান্ডকে অন্য এক ভূমিকম্পের ঝাঁকুনি ঠিকই দিয়েছে। ২০২১ সালের বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা জেতা দলটি চ্যাম্পিয়নশিপের আরেকটি চক্রে এসে প্রথম টেস্টেই কিনা বাংলাদেশের কাছে হেরে গেল ১৫০রানের বিরাট ব্যবধানে! নিয়মিত ভূমিকম্পে কেঁপে অভ্যস্ত দেশের টিম সাউদি-ড্যারিল মিচেলরা বাংলাদেশের ৫.৬ মাত্রার ভূমিকম্পটি যদি সেভাবে অনুভব না–ও করে থাকেন, তবু সিলেট আন্তর্জাতিক স্টেডিয়ামের হারটাই বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে খেলে আসা দলটির জন্য বড় এক দুলুনি।
ম্যাচটা বাংলাদেশ জিতে যেতে পারত গতকালই। বিশেষ করে ৩৩২ রানের লক্ষ্যে দ্বিতীয় ইনিংস খেলতে নেমে ৬০ রানে নিউজিল্যান্ডের পঞ্চম উইকেট পড়ে যাওয়ার পর মনে হচ্ছিল এই টেস্ট হয়তো পঞ্চম দিনের সূর্য দেখবে না। কিউই ব্যাটসম্যানদের বিপক্ষে মুহুর্মুহু আবেদন তুলছিলেন বাংলাদেশের বোলার-ফিল্ডাররা। কোনোটাতে ব্যাটসম্যান আউট হয়ে যাচ্ছেন, কোনোটা ভয় ধরিয়ে দিচ্ছে ব্যাটসম্যানের মনে।
ব্যতিক্রম ছিল কিছুটা আক্রমণাত্মক ব্যাটিংয়ে মিচেলের প্রতিরোধের চেষ্টা। টম ব্লান্ডেল, গ্লেন ফিলিপস, কাইল জেমিসনরা ছোট ছোট সঙ্গ দিয়ে গেছেন তাঁকে। এই করে করেই এক শ পার, শেষে এসে ইশ সোধিকে নিয়ে তো মিচেল পার করে দিলেন দিনটাই। শেষ এক ঘণ্টায় লড়াইটা হয়ে উঠেছিল এমন—বাংলাদেশ চায় নিউজিল্যান্ডকে অলআউট করে চতুর্থ দিনে ম্যাচ শেষ করতে। কিন্তু নিউজিল্যান্ডের পণ, ম্যাচ যে করেই হোক পঞ্চম দিনে নিতে হবে। এই নিয়ে কী হয় কী হয় একটা অবস্থায় পার হয়েছে শেষ বেলা। শেষ পর্যন্ত চতুর্থ দিন শেষে মিচেলের ৮৬ বলে অপরাজিত ৪৪ রানের সুবাদে কাল ‘জয়’টা হয়েছে নিউজিল্যান্ডেরই। বাংলাদেশ তো অন্তত চার দিনে টেস্ট জিততে পারল না!
কে জানে অদৃষ্টই হয়তো চেয়েছিল ভূমিকম্পের দেশের ক্রিকেটারদের হারের আগে একটু ‘হোম কন্ডিশনের’ মেজাজ দেওয়া যাক। কিন্তু সিলেট পর্যন্ত সেই মেজাজ খুব একটা এল না। তার মধ্যেই শেষ দিনে এসে নিউজিল্যান্ডের নতুন লড়াই—শেষ ৩ উইকেটে যতদূর নিয়ে যাওয়া যায় টেস্টটাকে। বাংলাদেশের লক্ষ্য ছিল যথারীতি যত তাড়াতাড়ি শেষ করা যায় টেস্ট, মাউন্ট মঙ্গানুইয়ের পর সিলেটেও নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে মেতে ওঠা যায় আরেকটি জয়োৎসবে।
সেই উৎসবের জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে ১ ঘণ্টা ২৬ মিনিট। প্রথম সাফল্যটা আসতে আসতেই ১০ম ওভার। ধৈর্যের পরীক্ষায় হার মেনে নাঈম হাসানকে সুইপ করেছিলেন ততক্ষণে অর্ধশত (৫৮) করে ফেলা মিচেল। ব্যাকওয়ার্ড স্কয়ার লেগে সেটাই দারুণ এক ক্যাচ হয়ে গেলে তাইজুল ইসলামের হাতে। ম্যাচটাকে পঞ্চম দিনে নিয়ে আসায় মিচেলের ১২০ বলে খেলা ৫৮ রানের ইনিংস এবং ইশ সোধির সঙ্গে তাঁর ৩০ রানের রাত পার করা জুটিটাকে বিশেষভাবে মনে রাখবে নিউজিল্যান্ড। অবশ্য যদি তাঁরা এই টেস্টটাকেই মনে রাখতে চায় আর কি!
এর ৮ ওভার পর দ্বিতীয় সাফল্যটা আসে সেই তাইজুলের হাত ধরেই, সাউদিকে শর্ট মিড উইকেটে জাকির হাসানের ক্যাচ বানিয়ে। টেস্টে ১২তম পঞ্চম উইকেট পাওয়ার আনন্দে মাতা তাইজুল মাঠেই অভিনন্দন পেয়েছেন প্রতিপক্ষ ব্যাটসম্যান ইশ সোধিরও। এরপর তাইজুলের আরেকটি উইকেটে ৭২তম ওভারের প্রথম বলেই হয়ে যায় জয়ের আনুষ্ঠানিকতা। ইশ সোধির এই ক্যাচটাও নিয়েছেন জাকির। দ্বিতীয় ইনিংসে ৭৫ রানে ৬ উইকেটসহ টেস্টে তাইজুলের উইকেট হলো ১০টি। এক টেস্টে ১০ উইকেট তিনি নিলেন এ নিয়ে দ্বিতীয়বার।
নিউজিল্যান্ড এই টেস্টের স্মৃতি ভুলে যেতে চাইলেও বাংলাদেশের কাছে ঘরের মাঠে কিউইদের প্রথম হারানো টেস্টটা চিরস্মরণীয় হয়েই থাকবে। টেস্টে বাংলাদেশের স্মরণীয় জয়গুলোরই একটি হয়ে গেছে এটি। বাংলাদেশের এখন পর্যন্ত জেতা ১৮টি টেস্টের মধ্যে দেশের বাইরের ৬টিতে জিম্বাবুয়ে ছাড়াও জয় আছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ, শ্রীলঙ্কা ও নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে। তার মধ্যে সেরা গত বছর জেতা মাউন্ট মঙ্গানুই টেস্ট। ঘরের মাঠে যদিও বাংলাদেশ হারিয়েছে ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়ার মতো দলকে; তবু সব মিলিয়ে মাউন্ট মঙ্গানুইয়ে ৮ উইকেটে পাওয়া জয়টাই সবচেয়ে এগিয়ে।
সিলেটের চা–বাগানে ঘেরা মাঠের বিশাল জয়টা মাউন্ট মঙ্গানুইয়ের পরই আসতে পারে কারণ, ঘরের মাঠে খেলা হলেও উইকেট থেকে এই টেস্টে অন্তত বাংলাদেশ বাড়তি কোনো সুবিধা পায়নি। চতুর্থ দিনের উইকেটেও ব্যাটিংটা প্রথাগতভাবে কঠিন মনে হয়নি। দুই ইনিংসে তাইজুলের ৮ উইকেট দেখে কারও মনে হতেই পারে বাংলাদেশের স্পিনাররা ভালো সহায়তা পেয়েছেন উইকেট থেকে। সেই সহায়তা আসলে তাঁরা আদায় করেই নিয়েছেন। নইলে নিউজিল্যান্ড দলেও তো স্পিনারের অভাব ছিল না।
প্রথম ইনিংসের মতো কাল দ্বিতীয় ইনিংসেও ৪ উইকেট নিয়ে কিউই ব্যাটসম্যানদের ব্যাটে শিকল পরিয়ে রেখেছিলেন বাঁহাতি স্পিনার তাইজুল। দুই অফ স্পিনার মেহেদী হাসান মিরাজ ও নাঈম হাসানও বেশি রান নিতে না দিয়ে প্রতিপক্ষ ব্যাটসম্যানদের চাপে রেখেছিলেন। তাইজুলের উইকেটগুলো হতে পারে সেটারই সুফল। আজ তো আরও ২ উইকেট নিয়ে টেস্টটাকেই নিজের করে নিলেন তিনি।
মাউন্ট মঙ্গানুই টেস্টটা যে রকম ছিল পেসার ইবাদত হোসেনের। ইবাদতের দুর্ভাগ্য, চোটের কারণে তিনি এখন দলে নেই। তাঁর শহরেই বাংলাদেশ আরও একবার নিউজিল্যান্ডকে হারালেও তিনি সে সুখবরটা পেলেন লন্ডনে বসে। চিকিৎসার জন্য আপাতত সেখানেই আছেন বাংলাদেশের মাউন্ট মঙ্গানুই জয়ের নায়ক।
সূত্র: প্রথম আলো
0 Comments